মো. জাহাঙ্গীর আলমঃ
বাংলা ও বাঙালীর স্বাধীকারের জন্য যুগে যুগে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। খুব কম মানুষই ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন। তবে কোন “পরিবার” ইতিহাসে জায়গা করে নেয়া বিরল। যা খুব কমই আছে। তেমনই এক অকুতোভয় শোষনের বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার বীর পরিবার।টাঙ্গাইলের ঐতিহাসিক সিদ্দিকী পরিবার। যারা শুধু টাঙ্গাইল নয় পুরো বাংলাদেশের গর্ব। এই পরিবারের জোষ্ঠ্য দুই সন্তান, মুক্তিযোদ্ধের অন্যতম সংগঠক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও বঙ্গবীর আব্দুল কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। যাদের অবদান সূর্যের আলোর মত উজ্জলমান দীপ্তিময়।
মুক্তিযোদ্ধে নেতৃত্বদানের জন্যে তাদের ছাড়তে হয় আপন জন। নীড় হারা ছন্নছাড়া হয়ে যায় পরিবার। স্বৈরাচাররা তাদের বাড়িঘর পুড়ে ছারখার করে দেয়।
তবুও সিদ্দিকীরা দমে যাননি, পরিবারও তাদেরকে পিছু নয়, সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরনাই দিয়েছে। জানার ভিতরের অজানাকেই জানানোই উদ্দেশ্য। একজনের সফলতার পেছনে থাকে তার নিজের সহ অনেক মানুষের ত্যাগ, ভালবাসা, অনুপ্রেরনা। তেমনই এক ত্যাগী একজন মানুষ মুরাদ সিদ্দিকী। যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কিশোর। যে বয়সে তার ব্যাট, বল নিয়ে খেলাধুলা করার কথা, সে বয়সে তিনি বন্ধুকের গুলি দেখেছেন। যে বয়সে তার মাতৃকোলে পরম যত্নে থাকার কথা, সে বয়সে তিনও জীবন বাঁচাতে মা, বাবার সাথে ঘুরে বেড়িয়েছেন বন বাদারে। রাতেরও আধারে অনিশ্চয়তার পথ দিয়েছেন পাড়ি। নয় মাস যুদ্ধের পর, ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাঙালীর মিলেছে স্বাধীনতার পর, চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে সিদ্দিকীদের দূর্বারতা। বঙ্গবন্ধু দেশে আসার পর, বঙ্গবন্ধু সিদ্দিকী পরিবারকে তার আপন পরিবারের মর্যাদা দেন। সন্তানসম করে দেখতেন সিদ্দিকীদের। ৭৫ এর ১৫’ই আগষ্ট ঘটে যায় ইতিহাসের বর্বরতম নেক্কার জনক ঘটনা। স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা স্থপতি জাতির পিতা সহ তার পরিবারের সকল সদস্যকে নৃশংস ভাবে হত্যা করে। জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে জান বিদেশে থাকার জন্য। ক্ষমতালোভী নরপিচাস হায়েনার দল সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনেক কাছের লোকরাই ভালবাসা নয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে মাথানত করে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহনে মত্ত হয়ে পড়ে। ৭ কোটি অসহায় মানুষ পিতৃহারা হলেও কোন সন্তানই সেদিন পিতৃ হত্যার প্রতিবাদে এগিয়ে আসেনি। কাপুরুষেরর ন্যায় সহ্য করেছে রক্ত চক্ষুকে। একমাত্র সিদ্দিকী পরিবারই সেদিন জীবন বাজি ধরেছে পিতৃহত্যার বদলা নিতে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী পিতৃহত্যার বদলা নিতে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেন। জাতীয় মুক্তিবাহিনীর ব্যানারে ঝাপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তৎকালীন সামরিক নরপিচাসদের মূর্তিমান আতংকে রূপ নেয় বঙ্গবীর।বঙ্গবীরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় মুক্তি বাহিনী ভারতের ভুমি ব্যবহার করে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল নিজেদের আওতাভুক্ত করেন। কিন্তু সেই সময় ভারতের নির্বাচনে শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীর পরাজয় হলে নতুন সরকার তাদের ভূমি ব্যবহার করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বিপাকে পড়ে জাতীয় মুক্তি বাহিনী। এদিকে বঙ্গবীরকে হত্যা করতে না পেরে স্বৈরাচার মুস্তাক সরকার সিদ্দিকী পরিবারের উপর দমন, নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। ছোট থেকে বড় কোন সদস্যই নিপীড়ন থেকে রেহায় পায়নি। ফলে বাধ্য হয়েই ভারতে আশ্রয়গ্রহন করতে হয় সিদ্দিকী পরিবারের মুরাদ সিদ্দিকীকে। তখন মুহাম্মদপুর গভঃ স্কুলে ৭ম শ্রেণির ছাত্র। একটা আদর্শ, ভালবাসা , পিতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালনের জন্য অনেক ত্যাগ, নীপিড়ন সহ্য করতে হয়েছে কিশোর মুরাদ সিদ্দিকী কেও। তাকেও চলে যেতে হয় পার্শবর্তী দেশ ভারতে। চলে গিয়ে দূর দেশে ছিলেন কষ্টের আবেশে পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যাওয়ার পরও কিশোর মুরাদ সিদ্দিকীর মনে গেঁথেছিল দূর্বিসহ সেই দিনগুলির কথা। আদর্শিক পিতার নির্মম মৃত্যুর ব্যথা। প্রতিক্ষনেই তার হৃদয় কুঠুরী ছিল ব্যথিত, মর্মাহত, চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। তথাপি পিতার লালিতস্বপ্ন ছিল বুকে। তাই পথচলা শুরু করল বসে না থেকে। তিনি জানতেন সুশিক্ষা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রূপান্তর সম্ভব নয়। মোহাম্মদপুর গভঃবয়েজ হাইস্কুল থেকে ভর্তি হন ভারতের শিলিগুড়ি হাইস্কুলে। চূড়ান্ত পরীক্ষায় দারুণ সফলতা পেয়ে ভর্তি হন বর্ধমান টাউন স্কুলে। সেখান থেকে কৃতিত্বের সাথে এস.এস.সি পাশ করেন। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী মুরাদ সিদ্দিকী ভর্তি হন বিখ্যাত আশুতোষ কলেজে। সেখানেও সফলতার সাথে প্রথম বিভাগে এইচ.এস.সি পাশ করেন। লয়ে উচ্চশিক্ষা, সৎ সুন্দরের দীক্ষা ভর্তি হলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে । নিজেকে গড়তে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের আলয়ে। কারন পিতাও তো ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র। যাইহোক এদিকে বাংলাদেশে ঘটতে থাকা নানা অভ্যুথানে জন জীবন বিপর্যস্ত। অবস্থা বেগতিক দেখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয় বঙ্গবন্ধুর খুনীরা। পড়াশোনার ব্যস্ততার মাঝেও তিনি নিজের দেশের সব খবর রেখেছেন নিজের গোচরীভূত। আল্লাহতালা যাকে কবুল করেছেন মানুষের সেবায়। তার কি আর বেখেয়ালী হলে হয়?
১৯৮৩ সালে স্বৈর সামরিক সরকার সিদ্দিকী পরিবারের প্রতি দমন পীড়নে কিছুটা নমনীয় হলে মুরাদ সিদ্দিকী দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরারা পর মুরাদ সিদ্দিকী করটিয়া সরকারি সা’দত কলেজে ভর্তি হন। রিক্ত যাহার বীরের ধমনি চিত্তে যাহার বঙ্গবন্ধুর আদর্শ লালিত। সে কি করে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠনের দুর্দিনে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে!! অনেক ত্যাগ কষ্ট ভোগের পরও বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা ভালবাসার কারনে।
বঙ্গবন্ধুর দলকে ভুলতে পারেননি। দেশে আসার কিছুদিনের মাথায় কোমায় যাওয়া টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের হাল ধরেন মুরাদ সিদ্দিকী। টাঙ্গাইলের প্রতিটি শহর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ঘুরে ঘুরে কর্মী সংগ্রহ শুরু করেন। প্রখর মেধা প্রজ্ঞা আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ভালবাসার জয়গানে প্রান এল কোমায় যাওয়া ছাত্রলীগের প্রাণে। মুরাদ সিদ্দিকীর বিমোহিত করা নেতৃত্বে দুরন্ত,দুর্বার গতিতে চলতে থাকে টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। তৃনমুলে তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয় গেল। মুরাদ সিদ্দিকী দৃঢ় প্রজ্ঞার সাথে সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সমর্থ হন। তার নেতৃত্বে চলতে থাকে স্বৈরাচার বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম। যার ফলশ্রুতিতে স্বৈরাচার সামরিক সরকারের রক্তচক্ষুর রোষানলে পড়েন মুরাদ সিদ্দিকী। বার বার কারা বরণ করতে হয় তাকে। মানুষ, মানবতা, সত্য, ন্যায়ের গনতন্ত্রের পক্ষে কথা বলার জন্য। তবুও তিনি দমে যাননি। অন্যায়,অবিচার,সন্ত্রাস,চাঁদাবাজ, দুর্নিতির বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি ভালবাসা, দায়বদ্ধতার কারনে। জাতির পিতার দেখানো পথে অবিচল আছেন, থাকবেন। কোনদিন এর ব্যত্যয় ঘটবেনা।
মো. জাহাঙ্গীর আলম, রাজনীতিক কর্মী।