মির্জাপুর প্রতিনিধিঃ
টাঙ্গাইলের মির্জাপুর রণদা নাট মন্দিরে রোববার(২২ নভেম্বর) বাঙালির কৃতি সন্তান, প্রখ্যাত লোকহিতৈষী দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার(আরপি সাহা) ১১৯তম জন্মজয়ন্তি নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল আরপি সাহার প্রতিকৃতিতে পুস্পার্ঘ অর্পণ, আত্মার শান্তি কামনায় ধর্মীয় রীতি অনুসারে প্রার্থনা, কর্মময় জীবনের উপর আলোচনা সভা ইত্যাদি।
এ উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন রণদা প্রসাদ সাহার একমাত্র পৌত্র ও কুমুুদিনী কল্যাণ সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাজীব প্রসাদ সাহা। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, বিশিষ্ট সাংবাদিক বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ও এটিএন বাংলার এডিটর-ইন-চীফ এবং ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের নির্বাচিত সদস্য মনজুরুল আহসান বুলবুল। এছাড়াও অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
জানাগেছে, তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার টাঙ্গাইল মহকুমার অজপাড়াগাঁ মির্জাপুর গ্রামে বাংলা ১৩০২ সালে উত্থান একাদশীতে দেবেন্দ্র নাথ সাহা দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন দানবীর রনদা প্রসাদ সাহা। প্রতি বছর উত্থান একাদশী তিথিতে রনদা প্রসাদ সাহার জন্মজয়ন্তি পালন করা হয়। রণদা প্রসাদ সাহা ছিলেন একজন কর্মবীর এবং মানব সেবক। বাবার অভাব এবং টানাটানির সংসারে অতি কষ্টে বড় হয়েছেন রণদা প্রসাদ সাহা। বাবা দেবেন্দ্র নাথ সাহা চাকুরি করতেন জমিদারদের সেরেস্তাখানায়। তার অল্প আয়ে সংসার চালাতে পেরে উঠলেন না দেবেন্দ্র নাথ সাহা। তার মধ্য দিয়েই রনদাকে লালন পালন করতেন। বাল্যকালে রণদা ছিলেন ডানপিটে এবং দুরন্ত স্বভাবের।
রনদার বয়স যখন ৭ বছর তখন তারঁ ভাগ্যে নেমে আসে বিপর্যয়। শিশু বয়সেই তিনি হারান মা কুমুদিনীকে। অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় তিনি মারা যান। ওষুধ ও ডাক্তারের ভিজিট দিতে পারবেনা তাই সেদিন কোন ডাক্তার আসেনি রণদার বাড়িতে। শত চেষ্টা করেও গর্ভধারিনী-স্নেহময়ী মাকে বাচাঁতে পারেননি কিশোর রনদা। স্বচোখে মায়ের মৃত্যু দেখার পর রনদার জীবনে বিরাট পরিবর্তন আসে। সেদিন তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন ‘আমার মায়ের মতো আর কোন মাকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে দিব না’। মায়ের মৃত্যুর ৬ মাস পর বাবা দেবেন্দ্র নাথ দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বিমাতার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে পড়েন রনদা। রনদার বয়স যখন ১৪ তখন তিনি ভাগ্য অন্বেষনে চলে যান কলকাতায়। প্রবাস জীবন হয়ে ওঠে আরও কষ্টের। জীবন বাচাঁতে এমন কাজ নেই যা রণদা করেননি।
পত্রিকা বিক্রি ও গাড়ি ধোয়া মোছার কাজ তিনি যতেœর সঙ্গে করেছেন। যখন তার বয়স ১৭ বছর তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। বিশ্বযুদ্ধের সময় অন্যান্য বাঙালির মতো তিনিও বাঙালি সেচ্ছাসেবকের সঙ্গে বেঙ্গল অ্যাম্বুলেন্স কোরে যোগ দেন এবং মেসোপটেমিয়ায় চলে যান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য তিনি নব প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন প্রাপ্ত হন। এ সময়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দু’জনের মধ্যে। পরে কাজী নজরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে এবং রণদা প্রতিষ্ঠা লাভ করেন ব্যবসায়ী হিসেবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহনের পর রণদার জীবনে নবতর দিকদর্শন লাভ করেন।
প্রথমতঃ গরিব ও দুস্থ মানুষের সেবা। দ্বিতীয়তঃ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণির মানুষের সমন্বয়ে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ গঠন। তৃতীয়তঃ শৃঙ্খলাবোধ। এই তিনটি আদর্শকে সামনে রেখে রেলওয়ে বিভাগে স্বল্প বেতনের চাকুরি দিয়ে রনদা কর্মজীবন শুরু করেন। রনদার বয়স যখন ৩৫ বছর তখন তিনি রেলওয়ের চাকুরি ছেড়ে দিয়ে কয়লার ব্যবসা শুরু করেন। কয়লার ব্যবসায় রণদা দ্রুত প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ৫৫টি জাহাজসহ বিআরএস কোম্পানী ক্রয় করেন। রনদা প্রচুর ধন-সম্পত্তির মালিক হয়েও নিজের জন্য কিছুই করেননি। কষ্টার্জিত সব ধনসম্পদ আর্তমানবতার সেবায় বিলিয়ে দিয়েছেন।
মির্জাপুরের লৌহজং নদীর তীরে এশিয়াখ্যাত ৭৫০ বেডের কুমুদিনী হাসপাতাল তার জ্বলন্ত সাক্ষী। তার অন্যান্য কীর্তির মধ্যে নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতেশ্বরী হোমস, টাঙ্গাইল শহরে কুমুদিনী মহিলা কলেজ (বর্তমানে সরকারি), মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ (বর্তমান সরকারি) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি মির্জাপুরে একটি মহিলা মেডিকেল কলেজ করার জন্য চারতলা ভবনের দ্বিতীয়তলা সমাপ্ত করেন। বর্তমানে ভবনটি মির্জাপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। ভবনের কাজ সমাপ্ত করার আগেই ৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীর সদস্য ও তাদের এদেশীয় দোসররা তাকে এবং তার ছেলে ভবানী প্রসাদ সাহা রবিসহ কয়েকজনকে নারায়নগঞ্জের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। আজ পর্যন্ত তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তখন রণদা প্রসাদ সাহা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও তার একমাত্র পৌত্র রাজীব প্রসাদ সাহা তার ইচ্ছা ইতোমধ্যেই পূর্ণ করেছেন। ২০০১ সালে কুমুদিনী হাসপাতাল মেডিকেল কলেজে প্রতিষ্ঠা করা হয়। কুমুদিনী হাসপাতাল বর্তমানে কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। কলেজটিতে বর্তমানে ৭ শতাধিক ছাত্রী রয়েছেন। যার মধ্যে ৪০ ভাগ বিদেশী ছাত্রী রয়েছেন বলে কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. দুলাল চন্দ্র পোদ্দার জানান।