গণবিপ্লব রিপোর্টঃ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জাড়িত থাকার অপরাধে মৃত্যুদ- প্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর সব আইনি প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। ফলে অপরাধ মেনে নিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করে রাষ্টপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষা না চাইলে আজ-কালের মধ্যেই তাদের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এদিকে তাদের ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজের পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি রাজধানীর নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে এ কারাগারেরই রজনীগন্ধা কনডেমড সেলে বন্দী আছেন এ ২ যুদ্ধাপরাধী। এর আগে গতকাল সকালে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের পরিবারের সদস্যরা কারাগারে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
অবশ্য ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে তাদের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে তারা প্রাণভিক্ষা চাইবেন কি না-এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যরা সুনির্দিষ্ট করে গণমাধ্যমকে কিছুই জানাতে পারেননি। তার আগে জামায়াতের ২ নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করেননি তারা। জানা যায়, যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ আবেদন গত ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর খারিজ হয়েছিল, সেদিনই তার ফাঁসি কার্যকর হয়। দলটির আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করা হয় রিভিউ আবেদন খারিজ হওয়ার ৫ দিনের মাথায় চলতি বছরের ১১ এপ্রিল।
তবে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতেই সাকা চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে পড়ে শোনানো হয়েছে। কারাগার কর্তৃপক্ষ এবিনিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। তবে গত মধ্যরাত পর্যন্ত সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করার জন্য কোনো উদ্যোগের তথ্য জানা যায়নি। কারাগার সূত্র জানিয়েছে, তারা দুজনকেই পাশাপাশি দুটো কনডেমড সেলে রাখা হয়েছে। ওই সেলের অন্য সব বন্দীকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বৃহস্পতিবার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের ৪ সদস্যের বেঞ্চে দিনের কার্যক্রম শুরু হলে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের সংক্ষিপ্ত আদেশের বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, সংক্ষিপ্ত আদেশ নয়, শিগগির পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হবে। বেঞ্চের অপর বিচারপতিরা হলেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। এ বেঞ্চই গত বুধবার সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের দুটি রিভিউ আবেদনই খারিজ করে আদেশ প্রদান করা হয়।
সর্বোচ্চ আদালত সূত্রে জানা যায়, বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার কাজ চলে। বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটের দিকে সাকা চৌধুরীর পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেয়া হয়। ্র সন্ধ্যা ৬টা ৩৫ মিনিটে মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি ওই একই দপ্তরে আসে। এরপর দুটি রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের দপ্তর হয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পৌঁছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রারের হাতে। ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২-এ যথাক্রমে সাকা চৌধুরী ও মুজাহিদের বিচার হয়েছিল।
আদালত সূত্রে জানা যায়, সাকা চৌধুরীর রিভিউ খারিজের রায় লিখেছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। ১৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে একমত হয়েছেন বেঞ্চের অপর ৩ বিচারপতি। আর মুজাহিদের রিভিউ খারিজের রায় লিখেছেন বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ২৯ পৃষ্ঠার এ পূর্ণাঙ্গ রায়েও একমত হয়েছেন বেঞ্চের অপর ৩ সদস্য। এর পর সুপ্রিমকোর্টের ডেপুটি রেজিস্ট্রার আফতাবুজ্জামান, সিনিয়র লিগ্যাল রিসার্স অফিসার ফয়সাল, ডেসপাস রাইডার সিরাজুল ইসলাম, লাইব্রেরিয়ান তাপস চন্দ্র ও আন্তর্জাতিক অপরাধ টাইব্যুনালের (আইসিটি) অফিস সহকারী আবু মুসা রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি নিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছলে রাত ৮টা ৫০ মিনিটে কারাগারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গ্রহণ করেন।
পক্ষান্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কীভাবে দ- কার্যকর হবে, তা বিস্তারিত বলা আছে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার রিভিউ খারিজের রায়ে। আপিল বিভাগের ওই রায় অনুসারে, আদালতের আদেশ পাওয়ার পর আসামির পরিবারের সদস্যরা তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন। কারা কর্তৃপক্ষ আসামির কাছে জানতে চাইবে, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমার আবেদন করবেন কি না। যদি আসামি ক্ষমার আবেদন করতে না চান, তবে কারা কর্তৃপক্ষের দেরি না করে দ- কার্যকর করবে। এ ক্ষেত্রে জেলকোডের ৯৯১ বিধি অনুসারে রায়ের কপি পাওয়ার ৭ দিন পরে ও ২১ দিনের ভেতরে দ- কার্যকরের নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
অপরদিকে ঢাকা কেন্দ্রী কারাগারে রাতে রায়ের অনুলিপি পৌঁছানোর পর ২ বন্দিকে তা পড়ে শোনানো হয়েছে। এখন সাবেক এ ২ মন্ত্রীর মৃত্যুদ- কার্যকরের প্রস্তুতি নেবে কারা কর্তৃপক্ষ। তার আগে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ পাবেন দুজন। এ রায় কার্যকরের প্রস্তুতি হিসেবে কারাফটকে জোরদার নিরাপত্তা রয়েছে। সাঁজোয়া যান নিয়ে পুলিশের অবস্থানের পাশাপাশি রয়েছে র্যাবের টহলও। এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন চকবাজার থানার ওসি শামীমুর রশীদ ও র্যাব-১০ এর অধিনায়ক জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর মুজাহিদ ও সাকা চৌধুরীর মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। এর পরদিন এ ২ আসামির বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ পরোয়ানা কারাগারে আসামিদের অবহিতকরণসহ সংশ্লিষ্ট জায়গায় প্রেরণ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করার জন্য ১৫ দিন সময় পান সংক্ষুদ্ধপক্ষ। সে অনুযায়ি মুজাহিদ ও সাকা চোধুরী গত ১৪ অক্টোবর রিভিউ আবেদন দায়ের করেন। শুনানি শেষে গত বুধবার রিভিউ আবেদন খারিজ করে আদেশ দেয় আপিল বিভাগ। এখন রায় কার্যকরে আইনগত আর কোন বাধা নেই বলে জানান এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের জন্য অধীর আগ্রহে ছিলাম। তারও অবসান হলো। এখন শুধু ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষা।