বুলবুল মল্লিকঃ
টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে গত সেপ্টেম্বরে মা ও ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের প্রতিবাদে জনবিক্ষোভে পুলিশের গুলিবর্ষণ ও চারজন নিহত হওয়ার ঘটনার তদন্তে গঠিত পুলিশের তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দাখিল করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরে সম্প্রতি জমা দেয়া ৪১ পাতার তদন্ত প্রতিবেদনে ওই ঘটনার জন্য কতিপয় পুলিশ সদস্যের অপরিণামদর্শী আচরণ, যথাসময়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অভাব ও বিরোধী রাজনৈতিক জোটের ইন্ধনকে দায়ী করা হয়। এজন্য ১১ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে কমিটি।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার চেষ্টা করলে চারজন মানুষ নিহত হওয়ার মতো ঘটনা না-ও ঘটতে পারত। এজন্য কালিহাতী ও ঘাটাইল থানার তৎকালীন দুই অফিসার ইনচার্জ(ওসি), চার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ও তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে টাঙ্গাইল থেকে প্রত্যাহার করার সুপারিশ করা হয়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর পুলিশের গুলিতে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনার পর পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (শৃঙ্খলা) আলমগীর হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন, টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আসলাম খান ও পুলিশের ঢাকা অঞ্চলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আখতারুজ্জামান।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৫ সেপ্টেম্বর কালিহাতী উপজেলা সদরের সাতুটিয়ায় রফিকুল ইসলাম নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে দরিদ্র পরিবারের এক মা ও তাঁর ছেলেকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেন। ওই মা ও ছেলের বাড়ি পাশের ঘাটাইল উপজেলায়। পরে এ ঘটনা জানাজানি হলে কালিহাতী ও ঘাটাইল উভয় এলাকার স্থানীয় লোকজন ১৮ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ করেন। বিক্ষুব্ধ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ গুলি করে। এতে চারজন নিহত হন। ঘটনার পর কালিহাতী ও ঘাটাইল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে সহ¯্রাধিক জনতাকে অভিযুক্ত করে দুটি মামলা দায়ের করে। এতে বলা হয়, দুই দল জনতার মধ্যে গোলাগুলিতে চারজন নিহত হয়েছেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, এলাকাবাসী ১৮ সেপ্টেম্বর কালিহাতী থানা ও নির্যাতনকারীদের বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচির আয়োজন করে। ওই দিন বিকাল পৌনে চারটায় ঘাটাইল উপজেলার হামিদপুর বাজারে বিক্ষুব্ধ লোকজন সমবেত হয়। পুলিশ তাঁদের ওপর লাঠিচার্জ করলে তাঁরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ভাংচুর শুরু করে। সেখানে কর্তব্যরত ঘাটাইল থানার এসআই মুনসুপ আলী তাঁর পিস্তল দিয়ে সাতটি গুলি করেন। তাঁর সঙ্গে থাকা অন্য পুলিশ সদস্যরাও উত্তেজিত লোকজনের উদ্দেশে গুলি করেন। এতে শামীম নামের এক ব্যক্তি মারা যান। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে কালিহাতী বাসস্ট্যান্ডে লোকজন বিক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। সেখানে কর্তব্যরত কালিহাতী থানার এসআই মোহাম্মদ সলিমউদ্দিন পিস্তল দিয়ে একটি গুলি, কনস্টেবল আমিনুল রাইফেল দিয়ে একটি গুলি, কনস্টেবল জিয়াউল হক ও তমাল চন্দ্র দেব শটগান দিয়ে পাঁচটি গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ফারুক হোসেন, শ্যামল চন্দ্র দাস ও রুবেল হোসেন নামের তিনজন মারা যান।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কালিহাতী বাসস্ট্যান্ডে পুলিশ সদস্যরা গুলি করলেও থানার তৎকালীন ওসি মো. শহীদুল ইসলাম গুলিবর্ষণের সঠিক সংখ্যা এবং হতাহত ব্যক্তিদের সংখ্যা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে পুলিশ সদস্যদের জন্য বরাদ্দ করা গুলির সংখ্যা ঠিক আছে।
আর এ স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে বিক্ষোভ হলেও ঘাটাইল থানার ওসি মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান তা প্রতিরোধের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। তিনি উত্তেজনা প্রশমনে জনসংযোগ করেননি। এমনকি ঘটনাস্থলে অবস্থান না করে থানায় অবস্থান করেন। পরে ভয়াবহতা ব্যপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে যেনতেনভাবে ঘটনাস্থলে হাজির হন; যা তাঁর কর্তব্যের অবহেলা, অদক্ষতা ও উদাসীনতা বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে টাঙ্গাইলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার সঞ্জয় সরকার এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মোহাম্মদ শফিকুর রহমান তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়েছেন উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা ঘটনার দিন পুলিশ সদস্যদের মোতায়েনের আগে কোনো প্রকার নির্দেশনা দেননি। এ ছাড়া মা ও ছেলেকে নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়, সে ব্যপারে কোনো পদক্ষেপ নেননি। এই দুই কর্মকর্তাকে টাঙ্গাইল থেকে প্রত্যাহার করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
তদন্ত কমিটি কালিহাতী থানার তৎকালীন ওসি মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম (বর্তমানে রংপুর অঞ্চলে সংযুক্ত), ঘাটাইল থানার তৎকালীন ওসি মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান (বর্তমানে খুলনা অঞ্চলে সংযুক্ত), কালিহাতী থানার এসআই মো. আবুল বাশার, ছলিমউদ্দিন, কনস্টেবল আমিনুল ইসলাম, জিয়াউল হক ও তমাল চন্দ্র দেব এবং ঘাটাইল থানার এসআই ওমর ফারুক ও মুনসুপ আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে। এ ছাড়া ঘাটাইল থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. হারুন অর রশিদকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে বদলি করতে বলা হয়।
এ রবিষয়ে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে দোষী প্রত্যেককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
