ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধিঃ
টাঙ্গাইলের গোপালপুরে ঘটনার ২০ দিন পর সাজানো ছবিতে বানোয়াট খবর প্রকাশের ঘটনায় জেলার মিডিয়াঙ্গণে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। পৌর নির্বাচনের ঢামাঢোল ছাপিয়ে সাংবাদিক মহলে স্থান করে নিয়েছে ওই সংবাদ। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে লজ্জা নিবারণে বাসন্তির জাল পরা ছবির অনুকরণে ওই ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে জানাগেছে, সম্প্রতি টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার বীরনলহরা গ্রামে সাজেদা বেওয়া নামক এক মহিলাকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের খবর ছাপা হয় দৈনিক আমার সংবাদ, দৈনিক সরেজমিনবার্তা, দৈনিক গ্রামের কথা, দৈনিক গ্রামগঞ্জের খবর, সাপ্তাহিক যুগধারা সহ আরো কয়েকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিকে। জেলা প্রতিনিধি, বিশেষ প্রতিনিধি, ভ্রাম্যমান প্রতিনিধি ইত্যাদি পদবির বরাতে এসব খবর ছাপা হয়। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, পাড়াপড়শি এবং এলাকার সুধিজন বানোয়াট ছবিতে মিথ্যা খবর প্রকাশে বিস্মিত হন। তারা এসব সাংবাদিক নামধারি দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ভিকটিম সাজেদা বেওয়ার স্বামী জাফর আলীর মৃত্যুর পর তিন ছেলেকে নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে শাহজামাল ঢাকায় গামের্ন্টসে চাকুরি করেন। দ্বিতীয় শাহজাহান ট্রাক ড্রাইভার। তৃতীয় ছেলে শামীম স্থানীয় হাইস্কুলে পড়ে। দ্বিতীয় ছেলে শাহজাহানের স্ত্রী ফরিদা বেগম, নাতনি পাখি এবং ছোট ছেলে শামীমকে নিয়ে যৌথ পরিবার। 
বাড়ির কাছে নলহরা মৌজার এসএ ২৩ নং খতিয়ানের ১৭২ দাগের ১০৮ শতাংশ জমির মধ্যে ৩১ শতাংশ নিয়ে গ্রামের আব্দুল মজিদ গংদের সাথে তাদের বিরোধ চলছে। এ নিয়ে মামলায় (পিটিশন-৩৭/৯২-৭(৪)৯২) টাঙ্গাইলের প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বিগত ১৬/০৮/১৯৯২ তারিখে আব্দুল মজিদ গংদের অনুকূলে নিস্পত্তি দেন। আদালতের এ নিস্পত্তিকে ভিত্তি করে আব্দুল মজিদ গং ভূমি অফিসে পৃথক হোল্ডিং খুলে খাজনাদি পরিশোধ করেন। সম্প্রতি আব্দুল মজিদ চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে ওই জমি হালচাষের উদ্যোগ নিলে বিবাদ শুরু হয়। সাজেদা বেওয়া ও তার তিন ছেলে আব্দুল মজিদ গংদের কেনা ও দখলীসূত্রের ওই জমিতে যেতে বাধা দেন। স্থানীয়ভাবে মিমাংসা না হওয়ায় বিষয়টি গোপালপুর উপজেলা পরিষদের ভাইসচেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ পর্যন্ত গড়ায়। তিনি জানান, লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর উভয় পক্ষকে নোটিশ করে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ হাজির হতে বলা হয়। কয়েক দফা নোটিশ সত্বেও সাজেদা গং হাজির না হওয়ায় ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের দেয়া রায় এবং জমির খাজনাখারিজ মূলে গত ১৯ অক্টোবর আব্দুল মজিদ গংদের পক্ষে পর্যবেক্ষণমূলক রায় দেয়া হয়। এরপর সাজেদা বেওয়া গত ৯ নভেম্বর টাঙ্গাইলের সহকারি জজ আদালতে ওই জমিতে অস্থায়ী অন্তবর্তকালিন নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেন। বিবাদী আব্দুল মজিদ গত ১৭ নভেম্বর আদালতে হাজিরা দিয়ে অভিযোগের আপত্তি দাখিলমূলে সময় প্রার্থনা করেন। এরই পরিপ্র্রেক্ষিতে গত ২৫ নভেম্বর আব্দুল মজিদের লোকজন ওই বিবদমান জমিতে টিনের ছাপড়া উঠান।
সাজেদা বেওয়ার পড়শি স্বপ্না পারভীন জানান, ‘১০-১২জন লোক আইয়া ওই জমিতে কয়েক ফর্দ টিনের ছাপড়া উঠায়। সাজেদা বেওয়া বাধা দিলে গালিগালাজ আর ভয়ভীতি দেহায়’। সাজেদার চিৎকার ও চেঁচামেচিতে গ্রামের শতাধিক মানুষ জড়ো হয়ে ছাপড়া তোলার দৃশ্য দেখেন। স্বপ্না পারভীন আরো জানান, ‘কাউকে গাছের হাতে বাইন্দা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে নাই। কয়দিন পরে অপরিচিত লোকজন সিএনজি দিয়া আইয়া গ্রামের মোড়ে পত্রিকা ফালাইয়া যায়। হেই পত্রিকা পইড়া গ্রামের চেংড়াবুড়া সবাই কইতাছে সাজেদা বুড়িরে নাকি গাছের হাতে বাইন্দা পিটাইছে।’
সরেজমিনে দেখা যায়, সাজেদা বেওয়ার বাড়ির চৌহদ্দীতে কোনো বেড়া নেই। খোলা মাঠ থেকে বাড়ির উঠান দেখা যায়। আর যে কাঁঠাল গাছটিতে বেঁধে নির্যাতন করার ছবি পত্রিকায় ছাপানো হয় তা উঠানের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত।
প্রতিবেশি মনোয়ারা বেগম জানান, ‘ওই দিন কিছু লোক আইয়া জমিতে ছাপড়া উঠাইছে। সাজেদা বেওয়ার সাথে কথা কাটাকাটি অইছে। ঝগড়া অইছে। ধাক্কাধাক্কি অইছে। এর বেশি কিছু আমরা দেখিনাই।’ সাজেদা বেওয়ার বাড়ির পাশে আলমনগর গার্লস হাইস্কুল। এ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তাহেরা খানম জানান, ‘ওই দিন স্কুল খোলা ছিল। ছাত্রীদের কাছে জমি নিয়ে দুই পক্ষের ঝগড়াঝাটির কথা শুনেছি। প্রকাশ্য দিবালোকে গাছের সাথে বেঁধে একজন মহিলাকে মারধর করার বর্বর ঘটনা ঘটলে আমরা অবশ্যই জানতাম। ঘটনার ২-৩ সপ্তাহ পর কে বা কারা স্কুলের আঙ্গিনায় সাপ্তাহিক ও দৈনিক দুটি পত্রিকা রেখে যায়। ওই পত্রিকা পড়ে এ মিথ্যা খবর জানলাম। এরা সাংবাদিক নয় সাংঘাতিক। এদের বিচার হওয়া উচিৎ। গ্রামের মোড়েই বাড়ি কছিম উদ্দীন মাতব্বরের। তিনি জানান, ‘সকাল ৯টায় মোড়ে চায়ের দোকানে বসেছি। এরমধ্যে গোপালপুর থেকে ভূঞাপুরগামী সিএনজি থামিয়ে অপরিচিত একজন নেমে দুই কপি পত্রিকা বেঞ্চিতে রেখে যায়। পত্রিকার পাতা খুলতেই বানোয়াট খবর পড়ে অবাক হয়ে যাই। এটি কেমন সাংবাদিকতা? তিনি আরো বলেন, জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলছে। সেখানেই ফয়সালা হবে। তাহলে মিথ্যা ছবিতে মিথ্যা খবর কেন? ওই গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল খালেক জানান, জমির মালিকানা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। ছাপড়া তোলা নিয়ে ঝগড়া হয়েছে। গত ২২ ডিসেম্বর(মঙ্গলবার) স্কুলের দরজা খুলতেই টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক যুগধারা এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমার সংবাদ নামে দুইটি পত্রিকা মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখি। হাতে নিয়ে চোখ বুলাতেই ওই জঘন্য মিথ্যাচার নজরে পড়ে।
ঘটনার ব্যাপারে সাজেদা বেওয়া জানান, ওই দিন ২৫ নভেম্বর আব্দুল মজিদ ও তার ছেলে সোহেল ২০-২৫ দাঙ্গাবাজ নিয়ে বাড়িতে চড়াও হয়। তিনি আমতা আমতা করে বলেন, তারা তাকে ঘর থেকে টেনে হিচরে বের করে উঠানে গাছের সাথে বেঁধে মারধর করে। পরে জমিতে টিনের ছাপড়া তুলে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে চলে যায়। এখনো তারা প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। তাদের ভয়ে গ্রামের কেউ মুখ খুলতে পারছেনা। তিনি প্রতিকার চেয়ে গত ১৪ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর আবেদন করেছেন। থানা পুলিশকে কেন জানাননি প্রশ্নে বলেন, বিবাদীরা প্রভাবশালী। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেনা। নির্যাতনের পর হুশ এলে গাছ থেকে বাঁধন কে ছাড়ালো এমন প্রশ্নে জানান, ‘খেয়াল নেই। এ সময় কাছেই পুত্র বধূ ফরিদা, নাতনি পাখি ও পুত্র শামীম দাঁড়ানো ছিল। তাদেরকে গাছের সাথে বেঁধে মারপিট দেখেছেন কিনা প্রশ্ন করা হলে সবাই জানান, ভয়ে ঘরের মধ্যে ছিলাম দেখি নাই। এদিকে, পুলিশ সুপারের কাছে দায়ের করা অভিযোগ সরেজমিন তদন্তের দায়িত্ব পান গোপালপুর থানার এসআই হান্নান। তিনি গত ২১ ডিসেম্বর সাজেদা বেওয়ার বাড়ি ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি জানান, জমির মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা রয়েছে। ওই দিন আব্দুল মজিদ গং জমিতে ছাপড়া তুলতে গেলে ঝগড়াঝাটি ও ধাক্কাধাক্কি হয়। এতে সাজেদা সামান্য ব্যাথা পান। ঘটনাটি এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে গত ৩০ নভেম্বর আব্দুল মজিদ ও তার ছেলে সোহেল রানার বংশধরের সাথে একই গ্রামের মুক্তার হোসেন গংদের মারামারি হয়। উভয় পক্ষে ১৪-১৫ জন আহত এবং থানায় উভয় পক্ষ দুটি পৃথক মামলা দায়ের করে। ওই মামলায় গোপালপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউনুস ইসলাম তালুকদারের পিএ সোহেল রানাকেও আসামী করা হয়। সংঘর্ষের তিন দিন পর কালিহাতী উপজেলার ৩-৪ জন অতিউৎসাহী নামধারী সাংবাদিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অখ্যাত দুটি দৈনিকে একপেশে খবর প্রকাশ করে। মুক্তার হোসেনের ছেলে আল আমীন সাজেদার ছেলে শামীমের বন্ধু। একই গ্রামে পর পর দুটি ঘটনা ঘটায় এবং উভয় ঘটনার সাথে সোহেল রানার আতœীয়-স্বজনের জড়িত থাকার অভিযোগ থাকায় মুক্তার হোসেন ও সাজেদা বেওয়ার পরিবার এক হয়। আর মুক্তার হোসেনের ছেলে আল আমীন ও সাজেদা বেওয়ার পুত্র শামীম কালিহাতীর ওই ফরমায়েশী সাংবাদিকদের সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে গাছে বেঁধে নির্যাতনের সাজানো ছবি পাঠানোর পরামর্শ দেন। ওই সাংবাদিকদের পরামর্শ অনুযায়ী শামীম গত ১৫ ডিসেম্বর ওয়ালটন প্রিমো ইএফ-৩ মডেলের মোবাইলে প্রক্সি দেয়ার ভঙ্গিতে মায়ের ডামি ছবি ওই সাংবাদিকদের কাছে পাঠায়।
কম্পিউটরে পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ওই ছবি মোবাইলে ধারণ করা হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর। অথচ প্রকাশিত খবরের ঘটনা ২৫ নভেম্বর। এভাবে ২৫ নভেম্বরের বানোয়াট রিপোর্টের সাথে ১৫ ডিসেম্বরের ফরমায়েশী ও ডামি ছবি জুড়ে দিয়ে সাংবাদিক নামধারীরা সাংঘাতিক কাজটি সারেন।
আলমনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী জানান, ওই দিন তিনি ইউনিয়ন পরিষদে ছিলেন। অফিস থেকে ঘটনাস্থল চারশ গজ দূরে। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। ওরা ঘুষ খাওয়া সাংবাদিক। তাই দিনকে রাত বানায় আর রাতকে দিন। ওরা ‘হায়ারে’ আসে। ফরমায়েশী খবর লেখে। সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
গোপালপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মাসুমুর রহমান জানান, জেলা প্রশাসকের চিঠি পেয়ে তিনি অভিযোগটি তদন্ত করছেন। প্রাথমিকভাবে বলা যায় ঘটনাটি বানোয়াট।
গোপালপুর থানার অফিসার ইনচার্জ(ওসি) জহিরুল ইসলাম জানান, অসৎ উদ্দেশ্যে ছবি তৈরি করে যারা বানোয়াট রিপোর্ট প্রকাশ করে তারা সাংবাদিক জগতের কলঙ্ক। এদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
