দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় ব্রতী হওয়ার এখনই সময়

*ড. মো. হুমায়ুন কবীর*

গত ১৮ জানুয়ারি ২০১৬ নতুন বছরের নবান্নে প্রতি বছরের মতো এবারো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গণভবনে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। বাঙালির চিরায়ত কৃষ্টি-কালচারের নিদর্শন হিসেবে যুগে যুগে পরিচালিত ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছিল এ পিঠা উৎসব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বভাবজাতভাব ব্যক্তি শেখ হাসিনা হয়ে সেদিন অন্য দাওয়াতি মেহমানদের কাতারে একাকার হয়ে পড়েছিলেন। সেদিনের গণভবনের পিঠা উৎসবের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল, তিনি আমন্ত্রিত ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে প্রথাগত টেবিল-চেয়ার ছেড়ে বসে পড়েছিলেন চত্বরের ঘাসের ওপর মাদুর পাতা শীতল পাটিতে। সেদিন আবগতাড়িত হয়ে তিনি যে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিত্ব এবং দেশের প্রধানমন্ত্রী তা তিনি বেমালুম ভুলে গিয়ছিলেন। তিনি সেদিন সব রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ও নিরাপত্তাবলয় ভেঙে সাধারণ মানুষের কাতারে বসে গিয়েছিলেন। এগুলোই হলো আমাদের লাল-সবুজের পতাকাখচিত সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা গ্রাম-বাংলার অতিপরিচিত দৃশ্যাবলি। কালের কিংবা যুগের আবর্তনে সভ্যতার পরিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় যদিও এখন অনেক ঐতিহ্য ম্লান হতে চলেছে, ঠিক তখনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা বাংলাদেশের সরকার প্রধান কর্তৃক এ ধরনের অনুষ্ঠান উদযাপন সত্যিই আমাদের গৌরবান্বিত ও অনুপ্রাণিত করে। সেইসঙ্গে প্রত্যককে করে নস্টালজিকও। এভাবে শহরে ইট-পাথরের ভেতর থাকা যান্ত্রিক মানুষগুলোর মনের কোণে সামান্য হলেও সাময়িক খোড়াক জোগাড় হয় বৈকি। আমাদের আবহমান চিরায়ত বাংলা কৃষ্টি-সংস্কৃতিতে খুবই সমৃদ্ধ। সারা বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এসব ঐতিহ্য পালনের খবরা-খবর প্রায়শই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। আর খাঁটি বাঙালি হিসেবে অবশ্যই তা সবার হৃদয়-প্রাণে-মনে দোলা দেয়। এখন আমি সাম্প্রতিক সময়ে পালিত হওয়া এ রকমই কিছু খবরাখবর নিয়ে আলাচনা করব।
কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলা সদরেও পালিত হয়ে গেল সেখানকার গ্রামাঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাহারি নানা রকমের শীতের ও আমন ধান উত্তোলন-পরবর্তী নবান্নের পিঠা উৎসব। প্রতি বছর ঠিক এ মৌসুমেই সেখানে এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। এবারেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। সেই পিঠা উৎসবে এলাকার অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে তার স্বাদ গ্রহণের চেষ্টা করেছেন। এ সময়ে নবান্নের এ পিঠা উৎসব ঘরে ঘরে, বাড়িতে বাড়িত, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় তাদের প্রত্যেকের এলাকাভিত্তিক স্ব-স্ব ঐতিহ্যের নানা রকম পিঠা উৎসব পালিত হয়ে থাকে। সেই পিঠা দিয়ে আবার চলে জামাই, আতœীয়-স্বজন আদর-আপ্যায়নের মতো দাওয়াতি ও মেজবানি অনুষ্ঠানাদি। এইতো মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকায় অবস্থানরত বৃহত্তর ময়মনসিংহের কয়েকটি সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত ব্যতিক্রমধর্মী একটি অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়ে গেল ঢাকা ক্লাব প্রাঙ্গণে। বৃহত্তর ময়মনসিংহের অন্তর্গত ঐতিহ্যবাহী কিশোরগঞ্জ জেলার কৃতীসন্তান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ সেটি উদ্বোধন করেন। সেখানে আয়োজিত মেলায় পিঠা-পুলি, মেজবানি দাওয়াত খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা হয়েছে। সেখানে মহামান্য রাষ্ট্রপতিও সব রাষ্ট্রীয় প্রটোকল নিরাপত্তা পেরিয়ে পরিচিত সব মানুষের সঙ্গে সেদিন মিশে গিয়েছিলেন তিনি। শীতের এ শুকনো মৌসুমে চারদিকে যখন দিগন্ত বিস্তৃৃত খোলা মাঠ থাকে, তখন বাংলার গ্রামাঞ্চলের চারদিকে এসব অনুষ্ঠান উদযাপনের ধুম পড়ে যায়।
সম্প্রতি প্রতি বছরের মতো এবারো দেশের বিভিন্ন স্থানে সেরকম কিছু সংঘটিত ঐতিহ্যের বর্ণনা করব। অনেকে জেনে থাকবেন, ময়মনসিংহ অঞ্চলের ফুলবাড়িয়া উপজেলা এলাকার উত্তরের একটি অংশ এক সময় ত্রিশাল উপজেলার বৈলরের জমিদার এবং দক্ষিণের আরেক অংশ মুক্তাগাছার জমিদারের শাসনের দখলে ছিল। সেখানকার জনশ্রুতিমতে, দুই জমিদারের প্রজাদের জমির পরিমাপ সংক্রান্ত জটিলতা চলত দুইপক্ষের মধ্যে। সেই সময়কার দুই জমিদারের এ সমস্যা নিরসনের কৌশল হিসেবে তারা সম্মত হয়ে, তামা ও কাঁসার তৈরি একটি ধাতব বস্তুকে ‘গুটি’ নামে তা দিয়ে একটি খেলার প্রচলন করেছিল। সেই অঞ্চলের বিখ্যাত গুটি খেলাকে কেন্দ্র করে সেখানে গণমানুষের সমাগম হয়ে বিরাট মেলা বসে যায় সেখানকার রাস্তার ওপর। সেই খেলাটির মূল মাহাতœ্য হলো, গুটিটি কে কার দখলে রাখতে পারে। যে বছর গুটি খেলায় যে পক্ষ জিতে যাবে সেটি পুরো এক বছরই তাদের দখলে থাকবে। ঐতিহ্যবাহী এ খেলাটি সেই জমিদারি আমল থেকে শুরু হয়ে ২৩৭ বছর যাবৎ এখনো সেখান তা চালু রয়েছে। রীতি অনুয়ায়ী প্রতি বছর বঙ্গাব্দের পৌষ মাসের শেষের দিনে এ খেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। আর এ খেলাকে কেন্দ্র করে সেই নির্ধারিত দিনের দু’একদিন আগে-পরে আশপাশের গ্রামে মানুষের ঢল নামে। এবার ২০১৬ সালের ১৩ জানুয়ারি মঙ্গলবার হয়ে গেল সেই এতিহ্যবাহী ২৩৭তম গুটি খেলার পর্বটি। আশপাশের গ্রামসহ পুরো ময়মনসিংহ জেলার ক্রীড়ামোদি মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিবর্গ তা উপভোগ করতে চলে আসেন। অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে হাজার হাজার দর্শক তা উপভোগ করে থাকে। পত্রিকার সচিত্র প্রতিবেদনে জানা গেছে, সম্প্রতি সিলেটের বিশ্বনাথে মহোৎসবে মাছ ধরার জন্য পলো উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ শীতকালে বিল-ঝিল, নালা-হাওর-বাঁওড় ইত্যাদি মুক্ত জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার সময় তলানিতে যে পরিমাণ মাছ অধরা থেকে যায়, তা একত্রে সংশ্লিষ্ট এলাকার সবাই মিলে ধরার জন্য বাঁশের তৈরি ত্রিশঙ্কু আকৃতির বিশেষ ধরনের যন্ত্র ‘পলো’ দিয়ে উৎসবের মাধ্যমে মাছ ধরার মজা গ্রামের মানুষ মাত্রই আছে। এ নিয়ে সারা দেশেই একেক এলাকার একেক ধরনের ঐতিহ্য বিদ্যমান। বৃহত্তর সিলেট এলাকায় যেটা পলো উৎসব, সেটা অন্য এলাকায় হয়তো অন্য নামে অন্যভাবে সংঘটিত হয়ে থাকে। কিন্তু উৎসবের অনুভূতি যে একই রকম তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আবার আরো খবরে জানা গেছে, প্রতি বছর হবিগঞ্জ এলাকায় একসঙ্গে মাছ ধরে সেখানে দেশি মাছের মেলা বসে। দেশের বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় সব প্রজাতির মাছই পাওয়া যায় সেই নির্ধারিত মেলায়। সেখানেও প্রতি বছরের নির্ধারিত দিনে ২-৩ দিনব্যাপী মাছ মেলা চলতে থাকে। অনেকে সেখান থেকে খোঁজ-খবর রেখে প্রয়োজনীয় পরিমাণ ও জাতের অনেক মাছ কিনে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে তা তারা রেখে রেখে খায়।
পহেলা বৈশাখ এলে বাংলা নববর্ষের দিনে ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জের নদীর চরে দুই গ্রামের মধ্যে লম্বা দড়ি দিয়ে ‘কাছি’ টানাটানি খেলা হয়। সেই কাছি টানাটানিতে হাজার হাজার মানুষ অত্যন্ত আনন্দচিত্তে সেখানে দর্শক ও খোলোয়াড়ের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ঠিক তেমনিভাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, খুলনা, বরিশাল ইত্যাদি এলাকার ঐতিহ্য হলো বর্ষা মৌসুমে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। সে এলাকার জন্য তা খুবই জনপ্রিয় খেলা। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়াসহ এতদাঞ্চলের আরো কিছু এলাকার ঐতিহ্যবাহী এবং জনপ্রিয় খেলা হলো এক জোড়া হালের গরু দিয়ে হাল দৌড়, মই দৌড় এবং ঘোড়া দিয়ে ঘোড়দৌড় ইত্যাদি। কিন্তু এখন শীতকালে বোরো আবাদের কারণে পতিত মাঠ না থাকার জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ এ খেলাগুলো বন্ধ ছিল। তবে যখনই সেসব এলাকার পুরনোকালের মানুষরা সুযোগ পায় তখনই আবার তা অনুষ্ঠিত করে থাকে। সে জন্যই দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এবারে তা পুনরায় অনুষ্ঠানের খবর পাওয়া গেছে।
২৩ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে ইত্তেফাকের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরার সদর উপজেলার মাছখোলা গ্রামে একটি বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সেখানকার ১৫ জন গ্রামীণ গৃহবধূ কর্তৃক কুড়িয়ে আনা কিছু ঐতিহ্যবাহী ও ঔষধি গুণাগুণসম্পন্ন অপ্রচলিত শাকের মেলা বসেছিল। কচুর ডাঁটা, তেলাকচু, থানকুনি, কলমি, ব্রাহ্মি, জাত কুমড়ার ডাঁটা, দস্তাকচু, হেলেঞ্চা, সাঞ্চি, বেতশাক, কলার মোচা, ডুমুর, বউটুনি, পিপুল, বুনো ধনেপাতা, বথুয়া, শাকনটে, কাঁটানটে ইত্যাদি প্রায় অর্ধশতাধিক প্রজাতির ভেষজ ও উচ্চমাত্রার ভিটামিন খাদ্যমানসম্পন্ন শাক লতা-পাতা প্রদর্শন করা হয় সেখানে। অনাদি-অনন্তকালের ঐতিহ্যের সারথী হিসেবে ‘পাড়া মেলা’ নাম দিয়ে সেখানে অনেক বিনোদনেরও ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কম্পিউটারের এ ডিজিটালযুগে মানুষ এখন অনেক ঘরমুখো। এখন পূর্বকার সব ঐতিহ্য ইতিহাস হতে চলেছে। আমরা নিজেরাই আমাদের জীবদ্দশায় যেসব ঐতিহ্যের ভেতর দিয়ে বড় হয়েছি তা পরের প্রজন্ম অর্থাৎ আমাদেরই ছেলেমেয়েদের গল্প করে কিংবা উদাহরণ দিয়েও বুঝানো যায় না। আর সবচেয়ে বেশি সমস্যা হলো শহরের শিশুদের। কারণ তারা না পায় কোনো খেলার মাঠ, না পায় কোনো গ্রামীণ সংস্কৃৃতির ছোঁয়া। কাজেই এখন সময় এসেছে তাদের এগুলোর সঙ্গে পরিচিত করার এবং রাখার। সম্প্রতি বাংলাদেশর দুজন শীর্ষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি এমনই দুটি অনুষ্ঠানে নিজেদের সম্পৃক্ত করে আমাদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আবহমান বাংলার রূপবৈচিত্র্যের সে সব ঐতিহ্য পালনের মাধ্যম দেশীয় সংস্কৃতি চর্চায় আমাদের ব্রতী হওয়ার এখনই সময়।
লেখকঃ কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।