মনি খন্দকার
অনেক সময় কোন বিশেষ ঘটনাকে ঘিরে নিজের অনুভূতি বা প্রতিক্রিয়া জানাবার আগ্রহ হয়। একটি ঘটনার স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় আমরা তার মূল্যায়ন করতেও আগ্রহী। গত ৩ ডিসেম্বরের কথাই বলছি। যদিও ‘এটি’ জাতীয় জীবনের ঘটনা বহুল বা বিজয়ের মাসে বিজয় প্রসঙ্গে কোন কথা নয়। ঘটনা/অনুষ্ঠান: রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় নব্বই কিলোমিটার দূরে টাংগাইলের করটিয়া সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রাঙ্গণ/অডিটরিয়াম; বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের পঞ্চাশ বছর পূর্তি- ১৯৬৫ থেকে ২০১৫ খ্রি. ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’ উৎসব। বেশ ঘটা করেই আয়োজন। আয়োজকদের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে আন্তরিকতায় পূর্ণ এবং প্রচলিত ধ্যান-ধারণায় ও পথ-পরিক্রমায় তার সফল পরিসমাপ্তির জন্য দিনটি উপস্থিতির সুখস্মৃতিতে চির জাগরুক হয়ে থাকবে।
সকল জীবন ও নানান ব্যস্ততর সময়ে বিগত অর্ধশতাব্দীর ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক প্রমুখের আমন্ত্রণে ও উপস্থিতি নিশ্চিতে যে বিপুল শ্রম মেধা সময় নিয়োজিত হয় সেজন্য আমাদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। বিভাগীয় প্রধান স্নেহভাজন প্রফেসর আলীম মাহমুদের উষ্ণ আলিঙ্গনও ভুলবার নয়। কুয়াশাচ্ছন্ন ৩ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৭টা। বাংলা বিভাগ সুবর্ণ জয়ন্তীর সকল কর্মসূচী বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট ও দৃপ্ত কর্মধারায় চঞ্চল ছিল। সকাল ১০টা। শুরু হয় র্যালী। চিরায়ত হেমন্তের পরিচিত আবহে ‘সুবর্ণ জয়ন্তী’র সম্মুখে গজগমন, নেতৃত্বে নজরকাড়া ও উল্লসিত শত শত ছাত্র-ছাত্রীর মুখরিত শ্লোগান, টমটম আসনে অধ্যক্ষ আর বিভাগীয় প্রধানের মিলিত যাত্রা-র্যালী পরিচালনা। অনেক খুশির বন্যায় চৌদিক উৎসুক জনতার সারিবদ্ধ উঁকিঝুঁকি আর ঘন্টা দেড়েকে জমে যাওয়া-যানজট-কোলাহল-আনন্দ উচ্ছ্বাস এ পর্ব শেষ যখন, তখন শরীর মনে উষ্ণ সূর্যালোক। প্রদক্ষিণ পরে মিছিল পুনরায় কলেজ মাঠ খুঁজে পায়। দুপুর ১টা। শুরু হয় অনুষ্ঠান। সঞ্চালনা, উপস্থাপনা, বন্দনা, সূচনা সঙ্গীত-নৃত্য-গীত কোরিওগ্রাফ। চমৎকার।
আমাদের সংস্কৃতি, ভাষা-কথাবার্তা, আচার-আচরণ-কৃষ্টি সমেত অনেক বর্ণিল অবিবর্ণতার বিশৃঙ্খল ছোঁয়ায়-উত্তরণে ও আনুষ্ঠানিক সংযোগে দিনভর সময় অতিক্রান্ত হয়। আর সেই ধারায় অডিয়েন্সের সামঞ্জস্যপূর্ণ অনুষ্ঠানক্রম সাজানোয় পারঙ্গমতাই দেখা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির আবেশি ক্ষণ আমাদের সুন্দরতম মনারণ্যে মৌলিকত্বময় প্রেমাস্বাদ ও হৃদয়স্পর্শি ঢেউ জাগাতে পারে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যাঙ্গন সমাজের উপধারার প্রবল অবক্ষয় আগ্রাসন সরাসরি অপনোদনে জন্মসূত্রে যে মূলধারায় অগ্রসরমান তার বিস্মৃতির তলে খাবি খায়। বাংলা বিভাগও তার স্কন্ধে থাকা নানান দেউলিয়াত্বের উর্ধে উঠতে পারে না যে!
সুবর্ণ জয়ন্তীর আয়োজনের সংবাদটি অসুস্থ অনুজ শাহনূর মাসুদ তৈমুরের কাছ থেকে পেয়ে ফোনে কথা বলি সহযোগী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম খানের সাথে এবং জানতে পারি অনুষ্ঠানের দিন ক্ষণ ও নিয়ম কানুনের কথা। ঐ পর্যন্তই। এ প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ১৯৭৪ খ্রি. সা’দত কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হই। কিন্তু পঁচাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সপরিবারে নির্মম হত্যাকান্ডের পর আমার পড়ালেখায় দীর্ঘ সময়ের জন্য ছেদ পড়ে। ছাত্রলীগের কর্মী এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রেসিডেন্ট হত্যাকান্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ঢাকায় বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর তার সঙ্গে অপ্রকাশ্য গোপন আন্দোলনে যুক্ত হই। মূলতঃ এ সময় থেকে বাঙলা ভাষা, আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক আন্দোলন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি দূরভূমে নিক্ষিপ্ত হয়। দেশব্যাপী গ্রেফতার, হত্যা-সন্ত্রাস, জুলুম, নারকীয় পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরী হয়। আমাকে ঢাকায় গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে বন্দি ও পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তা আইনে পঁয়ত্রিশ মাস অর্থাৎ ১৯৭৫ এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৮ এর অক্টোবর পর্যন্ত আটক রাখা হয়। সে তো অনেক কথা। যাইহোক, আমরা মুজিব বিহীন বাংলায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও রাজনীতির স্বপ্ন দেখি, মুজিবীয় দর্শনে বিশ্বাস করি। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে আটাত্তরে বাংলা বিভাগের ছাত্র হই। তখন বঙ্গবন্ধু হত্যার সুবিধাভোগীদের শীর্ষে অবস্থানকারী সামরিক শাসক জিয়ার শাসনকাল। আর তখন স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দানা বাঁধছিল। বাঙালির বিজয়গাথা, ভূলুণ্ঠিত ইতিহাস তুরে ধরতে ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান খোকা (বীর প্রতীক)রা সা’দত কলেজ এবং তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ ছুটছেন। চার বছর পর পুনরায় ছাত্ররূপে সহযাত্রী হই আতাউল হামিদ, আলী আহমেদ, লুৎফর, জোয়াহের, বাবুল আনাহলী, মোহাম্মদ আলী, হরিদাস রায়, স্বপন চক্রবর্তী, শওকত জং, শহিদুল ইসলামদের। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির সম্মান রাখতে দেবাশীষ, লাহোর, কালাম, মীর ফরিদ, দিলরুবা, রোজী, আনু, স্বাতী, মেজবাহ, প্রমুখ অনুবর্তী হয় সেই আন্দোলনে। ছাত্রলীগ কূপমন্ডুুকতা আর ‘লাকী খান’ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে, দেয়াল পত্রিকা, সাময়িকী প্রকাশ করেছে, প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার আধার মুক্তিযোদ্ধা মুশফিক আবু স্যার, কবি মাহবুব সাদিক- মোস্তাফিজ সোনা, সুশান্ত স্যার, কবি আবু হাসানদের সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারীদের এক ব্যতিক্রম মেলবন্ধন আবহ সৃষ্টিতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে।
এক দিকে সামরিক জান্তার রক্তচক্ষু অন্যদিকে পেটোয়াবাহিনী। মিছিল মিটিং শ্লোগানে দমন পীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে সময় গড়িয়ে যায়। ইতিমধ্যে সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সাংগঠনিক জেলার মর্যাদা লাভ করে এবং আমি সিনিয়র সহসভাপতি থেকে সভাপতির দায়িত্ব অর্জন করি। সামরিক জান্তা জিয়ার ‘তখতে তাউস’ খান খান হওয়ার পরে আর এক সামরিক একনায়ক ক্ষমতা দখল করে। প্রায় এক দশক লালিত পালিত বর্ধিত হয় প্রত্যক্ষ সামরিক শাসনের যাতাকল; জিয়ার উত্তরসূরী হিসেবে এরশাদও ব্যক্তি ও রাজনৈতিক চরিত্র হননের মহোৎসবে লিপ্ত হয়। জিয়ার অনুসৃত পশ্চাৎপদ ও পরিত্যাক্ত ভাবধারা দেশের সকল প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস এবং অর্থনৈতিক মুক্তির রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার অপমৃত্যু ঘটায়। এরশাদ তার ‘চিতায় ঘৃত’ মিশ্রণে দেশব্যাপী গণধিকৃত ও গণবিচ্ছিন্নদের একত্রিত করে ‘জগাখিচুরি’র আর একটি সংস্করণে নতুন দল তৈরী করে। রাজনৈতিক বা আদর্শিক চেতনা খেলো করার এমন ঘৃণ্য তৎপরতা ও চক্রান্তের বিষক্রিয়া থেকে দেশের মধ্য-উত্তর অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্রলীগ প্রগতিশীল অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সুদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলে। অবশ্য সমসাময়িককালে ক্রিয়াশীল ও দৃশ্যমান ছিল স্বাধীনতা ও প্রগতি বিরুদ্ধ কতিপয় শিক্ষক ও ছাত্র সমাজের বিভ্রান্ত অংশ। পঞ্চাশ বছর পরেও এখানে ওখানে প্রায় কৃত্রিম যে ‘জোয়ার’ তার বিশ্লেষণ ও চৈতন্যগত উত্তরণ আমাদের সে সকল বিষক্রিয়া থেকে মুক্ত রাখতে পারে।
জাঁকজমকপূর্ণ সুবর্ণ জয়ন্তী’র অনুষ্ঠান উদ্বোধন ও পরন্ত বেলায় তার সমাপ্তি ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’-এর মতো কিন্তু হয়নি; মুহূর্তের মধ্যে অনুষ্ঠানের ছন্দপতনও ঘটেছিল। আমরা একটি কথা অনুষ্ঠানের স্বার্থেই উচ্চারণ করিÑবলি, অনুষ্ঠান ঘোষণায় যখন প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রী-সুধীজনের অনুভূতি প্রকাশে আমন্ত্রণ এবং এজন্য বেশ কিছু সময় উন্মুক্ত রাখা হয় তখন বিশেষ ক’জনকে নামোল্লেখে আমন্ত্রণ কেন? সা’দত কলেজের ইতিহাসে তেমন আমন্ত্রিতদের অতীত অবদান ভূমিকা বা কি কীর্তিই বা ছিল তাদের! এ নিয়ে নিন্দুকদের আরো অনেক কথা থাকতে পারে। সবিনয়ে বলে রাখি, আমরা অনেকেই কোন কোন অদৃশ্য বা প্রকাশ্য দুর্বলতায় পথ চলছি, না হলে আজও শূন্য কলসি’র আওয়াজ আর ‘হওয়া ডাইলে বাগাড়’-এ মরদ-কুর্দনের প্রবল অবস্থান দৃশ্যমান হতো না। তবে ইতিহাস যারা পড়ে না বা শিক্ষা নেয় না ইতিহাস থেকে তাদের প্রতি ইতিহাসের করুণা অমোঘ নীল তীর নিক্ষিপ্তই হয়।
monikhandokar@gmail.com
