পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রন্ত ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়ে ১৩ বছর আগে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল আবেদন গত মঙ্গলবার(২৪ মে) খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের ওই রায়ে পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান সংশোধন করতে ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আর ধারা সংশোধনের আগে এ ক্ষেত্রে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে সরকারকে বলা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে- ডিটেনশন (আটকাদেশ) দেয়ার জন্য পুলিশ কাউকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করতে পারবে না। কাউকে গ্রেপ্তার করার সময় পুলিশ তার পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য থাকবে। গ্রেপ্তারের তিন ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিকে কারণ জানাতে হবে। ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের (রিমান্ড) প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশক্রমে কারাগারের ভেতরে কাচ দিয়ে নির্মিত বিশেষ কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। কক্ষের বাইরে তার আইনজীবী ও নিকটাত্মীয় থাকতে পারবেন। জিজ্ঞাসাবাদের আগে ও পরে ওই ব্যক্তির ডাক্তারি পরীক্ষা করাতে হবে প্রভৃৃতি। এ রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার। আপিল আবেদন খারিজ হয়ে যাওয়ায় ওই নির্দেশনাগুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে ৫৪ ধারার অপব্যবহার বিশেষ করে সাদা পোশাকে গ্রেপ্তার, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের কালো অধ্যায়ের অবসান হবে বলে আশা করা যায়। উচ্চ আদালতের এই রায়কে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য, ১৯৯৮ সালের ২৩ জুলাই ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকা থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শামীম রেজা রুবেলকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২৪ জুলাই মিন্টো রোডের গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে মারা যান রুবেল। এ ঘটনায় রুবেলের বাবার দায়ের করা মামলায় রুবেলকে গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেন আদালত। সে সময়ের সরকার রুবেল হত্যা তদন্তের জন্য সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের পক্ষে কয়েকটি সুপারিশ করে। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে একটি রিট করে। ২০০২ সালের ২৯ নভেম্বর আদালত সরকারের প্রতি রুল জারি করেন। এরপর রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল হাইকোর্ট রায় দেন। হাইকোর্টের ওই রায়ে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রচলিত বিধান সংশোধন করতে ছয় মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। আর ধারা সংশোধনের আগে এ ক্ষেত্রে কয়েক দফা নির্দেশনা অনুসরণ করতে সরকারকে বলা হয়, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এ রায়ের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ চেয়ে সরকারের আপিল আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলো গত মঙ্গলবার(২৪ মে)। আপিল আবেদন খারিজ করে আদালত বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায়ে আরো কিছু গাইডলাইন দিয়ে দেয়া হবে। আদালত বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও ১৬৭ ধারার কিছু বিষয় দেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ছাড়া এসব ধারার অপব্যবহারের দৃষ্টান্তও দিন দিন বেড়েই চলেছে। পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয়ধারী দুর্বৃত্তদের শিকার হতে হচ্ছে নাগরিকদের। দেশে ক্রমবর্ধিষ্ণু গুম, হত্যা, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মতো ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির সদস্যের প্রতি অভিযোগের আঙুল উঠছে। এরকম একটি পরিস্থিতিতে আপিল বিভাগের এ রায়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও জনআকাঙ্খার প্রতিফলন।
উল্লেখ্য, সরকার পক্ষ থেকে স্থগিতাদেশ চাওয়া হলেও এতদিন কিন্তু হাইকোর্টের আদেশ বহালই ছিল। কিন্তু আদালতের কোনো নির্দেশনাই বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়নি রাষ্ট্রপক্ষ। এবার আপিল খারিজের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রী আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলেছেন। আমরা আশা করব উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সুপারিশগুলো বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টরা উদ্যোগী হবেন এবং আদালতের গাইডলাইন অনুসরণে বিতর্কিত আইনি ধারার সংশোধন প্রক্রিয়াও দ্রুত সম্পন্ন করবেন। অপরাধ দমনে ও জননিরাপত্তায় আইনের কঠোর প্রয়োগের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে সে আইনের ফাঁকফোকরে নাগরিকের অধিকার হরণ ও নির্যাতনের কোনো সুযোগ থাকলে তাও বন্ধ করা অবশ্যই দরকার।