গণবিপ্লব রিপোর্টঃ
টাঙ্গাইল জেলার ৮পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ের হিসাব-নিকাশে দলের আন্তঃকোন্দল প্রধান অন্তরায় হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ভোরে মাঠে গিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা এ আন্তঃকোন্দলে নাকানি-চুবানি খাচ্ছেন। সাধারণ ভোটার থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ের সকল নেতাকর্মীই এতে সম্পৃক্ত থাকায় এই আন্তঃকোন্দলই দলীয় প্রার্থীদের জয়-পরাজয়ে বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আন্তঃকোন্দল কোন দিকে মোড় নেয়, তার ওপর নির্ভর করছে নির্বাচনী পরিবেশও। এই মুহূর্তে নিজেদের অবস্থান থেকে প্রচার-প্রচারণা চালাতে গিয়েও বিপাকে পড়তে হচ্ছে জেলার আট পৌরসভার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের। দৃশ্যত, সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতা পেরোতে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের। দলীয় কোন্দলের পাশাপাশি তাদের পাঁচ বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে চার পৌরসভায়। সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।
আওয়ামী লীগঃ আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেতাকর্মীরা জানায়, আওয়ামী লীগের দুর্গ বলে পরিচিত টাঙ্গাইলে এখন দলটির রাজনৈতিক অবস্থা নানা বিপর্যস্ততা কাটিয়ে এখন কিছুটা স্তস্তিতে থাকলেও আন্তঃকোন্দলের কাঁটা ক্ষতে ঘা সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া ক্ষমতার আধিপত্য বিস্তার, টেন্ডার ভাগাভাগি, কাঙ্খিত পদ না পাওয়া, ভিন্ন মতের হওয়ায় দলের মধ্যে কোণঠাসা করে রাখার চেষ্টা ইত্যাদি কারণে আওয়ামীলীগের প্রার্থীরা দলীয় সমর্থনেও তৃণমূলে আশানুরূপ সহযোগিতা পাচ্ছেন না। কিছুদিন আগেও টাঙ্গাইলে আওয়ামীলীগের একচ্ছত্র অধিপত্য ছিল প্রভাবশালী ‘খান পরিবার’-এর। ক্ষমতার দাপটে খান পরিবারের চার ভাই জেলায় এক প্রকার ‘রামরাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা করে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দখল এবং নিজ দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে খুনোখুনিতে দলের হতাশ ত্যাগী নেতাকর্মীরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী খান পরিবারের চার ভাই হলেন, টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের এমপি আমানুর রহমান খান রানা, টাঙ্গাইল পৌরসভার বর্তমান মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাঁকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা। জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যাকান্ডে চার ভাইয়ের জড়িত থাকার বিষয়টি সামনে এলে তারা আত্মগোপনে চলে যান এবং ‘খান সা¤্রাজ্যে’ ধস নেমে আসে।
বীরমুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদ হত্যাকান্ড নিয়ে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ এখন তিন ভাগে বিভক্ত। এরমধ্যে ফারুক আহমদ হত্যায় জড়িত একটি গ্রুপ খান পরিবারের চার ভাই পলাতক; ক্ষমতাসীন গ্রুপটি সতর্ক; আর তৃতীয় গ্রুপটি অবহেলিত।
এক সময়ে একক আধিপত্য বিস্তারকারী জেলা আওয়ামী লীগের সামনের সারির ওই চার ভাই পলাতক থাকায় তাদের সমর্থক নেতাকর্মী-অনুসারী বাহিনী পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নেই। বরং তারা আড়ালে-আবডালে দলীয় প্রার্থীদের বিরোধীতা করছে-এটাকে দলীয় প্রার্থীদের জন্যে বড় ধরণের ঝুঁকি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
অন্যদিকে, ফারুক আহমদ হত্যার প্রতিবাদে তার স্ত্রী নাহার আহমদের নেতৃত্বে ‘নির্যাতিত আওয়ামী পরিবার’-এর ব্যানারে অন্য একটি গ্রুপ মাঠে রয়েছে। খান পরিবারের চার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় এই গ্রুপটি সক্রিয় হওয়ায় জেলার আওয়ামী রাজনীতির চিত্র অনেকটাই পাল্টে যায়। তবে দ্বিতীয় এই গ্রুপটির সাথে বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের একটি সমান্তরাল সু-সম্পর্ক রয়েছে। জেলা আওয়ামীলীগের সকল কার্যক্রমে এই গ্রুপটি সমর্থন দিয়ে থাকে। এদিকে, টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে নির্বাচিত এমপি আবদুল লতিফ সিদ্দিকী সংসদ থেকে পদত্যাগ ও দল থেকে বহিস্কৃত হলেও জেলা-উপজেলায় তার সমর্থক নেতা-কর্মীরাই দলের স্থানীয় শীর্ষস্থানে অবস্থান করছেন। তারা এখনও তার অনুসারী রয়ে গেছেন, তিনি আবার দলে ফিরে আসবেন বলে আশা করেন তারা অনেকেই। শোনা যাচ্ছে তার অনুসারী অনেকেই এখন জেলা আওয়ামীলীগের প্রতি আস্থাশীল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রুপ ক্ষমতাসীনদের মতামতকে প্রাধান্য দেয়ায় দলয়ি মেয়র প্রার্থীরা ওই সুবিধাটুকুও পাবেন। কিন্তু জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খঅন পরিবারের আস্থাভাজন আলমগীর খান মেনু নবগঠিত কমিটিতে থাকবেন বলে শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এ ক্ষেত্রে তার সঙ্গে থাকা জেলা-উপজেলার কিছু পদবঞ্চিত নেতাকর্মী এবং খান পরিবার সমর্থিত নেতাকর্মীরা একাট্টা হয়ে দলীয় মেয়র প্রার্থীর বিরোধীতা করায় আন্তঃকোন্দল ক্রমশঃ ব্যাপকতা পাচ্ছে।
জেলার সংসদীয় সব আসনে আওয়ামী লীগের এমপি থাকলেও গত উপজেলা নির্বাচনে তিনটিতে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিএনপি-সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী জয়ী হন। জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, দলীয় আন্তঃকোন্দলের অবসান না হলে উপজেলা নির্বাচনের মতো পৌর নির্বাচনেও দলটিকে খেসারত দিতে হতে পারে।
ঃকোন্দলের প্রভাব নির্বাচনে পড়বে বলে অনেকে আশঙ্কা করলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম তা উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি জানান, খান পরিবার ও তাদের অনুসারীরা প্রকাশ্যে মাঠে না থাকায় পৌর নির্বাচনে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না। বরং এরা মাঠে না থাকলে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর জন্য ভালো হবে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান সরকারের আমলে বিগত নির্বাচনগুলো অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এবারও তা-ই হবে। তার ধারণা জেলার ৮ পৌরসভায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিপুল ভোটে নির্বাচিত হবেন।
নৌকার প্রার্থীঃ টাঙ্গাইলের ৮টি পৌরসভায় দলীয় প্রার্থীরা হচ্ছেন, টাঙ্গাইল সদর পৌরসভায় দুবারের নির্বাচিত মেয়র জামিলুর রহমান মিরন; ভূঞাপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মাসুদুল হক মাসুদ; মধুপুরে মাসুদ পারভেজ; ধনবাড়ীতে খন্দকার মঞ্জুরুল ইসলাম তপন; মির্জাপুরে সাহাদৎ হোসেন সুমন; গোপালপুরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রকিবুল হক ছানা; সখিপুরে আবু হানিফ আজাদ ও কালিহাতীতে উপজেলা আওয়ামীলীগের আনছার আলী বিকম।
আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীঃ দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে চারটি পৌরসভায় মেয়র পদে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতা। তারা হচ্ছেন, গোপালপুরে বেলায়েত হোসেন ও আশরাফুজ্জামান আজাদ; ভূঞাপুরে আজহারুল ইসলাম; ধনবাড়ীতে জহুরুল ইসলাম হেলাল ও কালিহাতীতে হুমায়ুন খালিদ।
বিএনপিঃ পৌর নির্বাচনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীরা দলীয় চরম আন্তঃকোন্দলে জড়িয়ে রয়েছেন। দলের আন্তঃকোন্দলই বিএনপির বিষফোঁড়া হিসেবে আবিভূত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মতো টাঙ্গাইল জেলা বিএনপিও তিন ভাগে বিভক্ত। দলীয় কর্মসূচি একত্রে পালন করলেও বিভিন্ন সময় নিজেদের মধ্যে বসা ও সামনের কাতারে দাঁড়ানো নিয়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের দাবি, তিন ভাগে বিভক্ত হওয়ার কারণে বিগত সরকার বিরোধী আন্দোলন কর্মসূচি সফল হয়নি।
টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল ২০০৯ সালে। সে সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান সভাপতি, সাবেক উপমন্ত্রী ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি আব্দুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই কৃষিবিদ শামসুল আলম তোফা সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট ফরহাদ ইকবাল সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর থেকেই শুরু হয় আন্তঃকোন্দল।
ত্রি-ধারায় বিভক্ত দলের এক গ্রুপে রয়েছেন জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান; দ্বিতীয় গ্রুপে কৃষিবিদ শামছুল আলম তোফা এবং তৃতীয় গ্রুপে সাবেক মন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান।
দলের সভাপতি আহমেদ আযম খান বাসাইল-সখীপুরের সন্তান, তিনি বেশির ভাগ সময়ই ঢাকায় থাকেন। দলীয় নেতা-কর্মী ও লোকজনের সঙ্গে তার ওঠাবসা কম। সেজন্যই তাকে দিয়ে জেলার রাজনীতির তেমন একটা সুবিধা হচ্ছেনা।
গোপালপুর-ভূঞাপুরের বাসিন্দা সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ শামছুল আলম তোফাও বেশির ভাগ সময় থাকেন ঢাকায়। দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভ রয়েছে তার প্রতি।
তৃতীয় গ্রুপের নেতা মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান এসেছেন জাতীয় পার্টি থেকে। তিনি বিএনপির নেতাকর্মীদের চেয়ে জাতীয় পার্টি থেকে আসা নেতা-কর্মীদের বেশি কদর করেন। তিনিও বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকেন। জেলার শীর্ষস্থানীয় তিন নেতাই বেশিরভাগ সময় ঢাকায় অবস্থান করায় জেলা-উপজেলায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে পৌঁচেছে। অপরদিকে, দলটির জেলার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হামিদুল হক মোহন হোঁচট খেয়ে ছিটকে পড়েছেন দল থেকে। তার অনুসারীরাও নিষ্ক্রিয় দলীয় কার্যক্রমে। এই আন্তঃকোন্দল জেলা-উপজেলায় বিস্তৃত। এছাড়া নানা কারণে বেশির ভাগ নেতাকর্মী সরকার সমর্থিতদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন। ফলে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন না। এ কারণে ৮ পৌরসভায় বিএনপির ভরাডুবি হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ শামছুল আলম তোফা জানান, বিগত সময়ের দলীয় আন্তঃকোন্দল ইতিমধ্যে নিরসন করা হয়েছে। বর্তমানে দলে কোনো কোন্দল নেই। অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবং ভোটাররা ভোট দেয়ার সুযোগ পেলে পৌর নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীরাই জয়ী হবেন।
ধানের শীষের প্রার্থীঃ বিএনপির দলীয় প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে পৌর নির্বাচনে লড়ছেন, টাঙ্গাইল সদর পৌরসভায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দৌহিত্র ও টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শামসুল হকের ছেলে মাহমুদুর রহমান সানু, ভূঞাপুরে আব্দুল খালেক মন্ডল, মধুপুরে শহীদুল ইসলাম সরকার (সরকার শহীদ), ধনবাড়ীতে আব্দুস সোবহান, মির্জাপুরে হযরত আলী মিঞা, গোপালপুরে উপজেলা বিএনপির সভাপতি ও বর্তমান মেয়র খন্দকার জাহাঙ্গীর আলম রুবেল, সখিপুরে নাসির উদ্দিন ও কালিহাতীতে আলী আকবর জব্বার।