প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দায়িত্ব গ্রহণের পর এই এক বছরের মধ্যে অনেক গণমুখী কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। তিনি চেষ্টা করছেন আদালতের সর্বত্র বাংলা ভাষা চালু করতে; সেই সঙ্গে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি এবং রায়ের পূর্ণ বিবরণ যত শিগগির সম্ভব দেয়ার ব্যবস্থা নিতে। এর কিছু সফলতা দৃশ্যমান। করো কারো ভাষায় বিচার বিভাগের সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন প্রধান বিচারপতি। তবে এসব কারণে নয়, ভিন্ন কিছু কারণে সম্প্রতি দেশে সর্বমান্য বিচার বিভাগ আলোচনার তুঙ্গে এসেছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে এবং অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে বর্তমান প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার দুটো বক্তব্য নানা মহলে আলোচিত এবং নানাভাবে বিশ্লেষিত হচ্ছে। বক্তব্যগুলোর প্রেক্ষিত ও মর্মের দিকে গুরুত্ব না দিয়ে একটা পক্ষ বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন যা বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে আরেক পক্ষ এ থেকে নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে তৎপর হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত প্রধান বিচারপতির বক্তব্যগুলোর একটি হলো এরকম যে, নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগের ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাচ্ছে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখা সংবিধানের পরিপন্থী। প্রধান বিচারপতির প্রথমোক্ত বক্তব্য প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হয় যে, দেশে বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়েছে বলা হলেও বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্টরা এবং পর্যবেক্ষক মহলও মনে করেন, গৃহীত আইনি সংস্কারের পরও বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন সত্তা দিতে আরো অনেক দূর এগোনোর বাকি আছে আমাদের। কাজেই বর্তমান প্রধান বিচারপতির বক্তব্য একেবারে পূর্ব-অনুচ্চারিত কোনো কথা নয়। সাবেক বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে তার হতাশার কথা প্রকাশ করেছেন। এসব বক্তব্য তখনও সরকার-সংশ্লিষ্টদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আর অবসর গ্রহণের অনেক পরও বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে প্রধান বিচারপতির উষ্মার প্রেক্ষাপটটিও খুবই স্পষ্ট এবং বহুল আলোচিত। আমাদের দেশে উচ্চ থেকে নিম্ন আদালত সর্বত্র মামলার জট ভয়াবহ। অনেক মামলার রায় বছরের পর বছর ধরে দেয়া হচ্ছে না, ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বিচারপ্রার্থীদের। এমন কি আপিল বিভাগেও অনেক রায় বছরের পর বছর ধরে ঝুলে আছে। যেসব বিচারক ওইসব মামলা শুনেছেন তারা ইতোমধ্যে অবসর নিয়েছেন। জানা গেছে, হাইকোর্ট বিভাগে ঝুলে থাকা রায়ের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যাবে। এমনো হয় যে, বিচার প্রার্থীরা মামলা জেতেন কিন্তু রায় হাতে পাওয়ার আগেই মারা যান। প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব গ্রহণের পর আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছেন এ অবস্থা পরিবর্তনের। এ পরিপ্রেক্ষিতে অবসরের পর বিচারপতিদের রায় লেখার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রধান বিচারপতির দেয়া বক্তব্যের আইনি বিশ্লেষণে নেমেছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ যুক্তিহীনভাবেই ঢালাও সমালোচনা করছেন। আবার একটা পক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই বক্তব্যের সূত্র ধরে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের লেখা সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। অন্যদিকে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বেশ কিছুদিন ধরেই প্রধান বিচারপতিকে টার্গেট করে অনাকাঙ্খিত কিছু বক্তব্য ও আচরণ প্রদর্শন করে আসছেন। গত রোববার(৭ ফেব্রুয়ারি) সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে নজির বিহীন সংবাদ সম্মেলন করে ওই সাবেক বিচারপতি আরো একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন। আমরা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই, এসব কিছু কোনোভাবেই বিচার বিভাগের মর্যাদা রক্ষার অনুকূল নয়।
আমাদের চাওয়া, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট উদ্ভূত বিতর্কগুলোর দ্রুত অবসান হোক। বিচারপতিদের রায় লেখা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ও বিচার বিভাগের বিধি তৈরির মধ্য দিয়ে এ সংক্রান্ত বিতর্কের নিষ্পত্তি ও জটিলতার অবসান হতে পারে। আর বিচার বিভাগকে অধিকতর গণমুখীকরণে, বিচার প্রার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে প্রধান বিচারপতি যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন সেগুলো এগিয়ে নিতেও সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হবেন বলে আমাদের প্রত্যাশা।