ভোজ্যতেল নিয়ে তেলেসমাতির যেন কোনো শেষ নেই। বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার অজুহাত দিয়ে বা কোনো কারণ না দেখিয়েই দেশের বাজারে বেড়ে যায় ভোজ্যতেলের দাম। আবার বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিচে নেমে এলেও দেশের বাজারে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার কাছেই জিম্মি ভোজ্যতেলের বাজার। গত বছরের অক্টোবর মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় রকমের দরপতন ঘটেছে ভোজ্যতেলের। প্রায় দুই মাস পর দেশের বাজারে দাম কমাতে সরকার যেন কাকুতি-মিনতি করেই রাজি করিয়েছেন ব্যবসায়ীদের। তারা সয়াবিন তেলের দাম লিটার প্রতি ৫ টাকা দাম কমাতে সদয় হয়েছেন। গত শনিবার(১৬ জানুয়ারি) থেকে নতুন দাম কার্যকর হওয়ার কথা। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রীর বৈঠকে এরকম সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ পেয়েছে সংবাদ মাধ্যমে। ভোক্তারা এতে খুশি হয়েছেন। বলাই বাহুল্য, দেশে বর্তমানে প্রতিদিনের অবশ্য-দরকারি খাদ্যপণ্যের মধ্যে ভোজ্যতেল তুলনামূলক বেশি দামি। দাম কমার ঘোষণা শোনার পর থেকে ক্রেতারা আশা নিয়ে দোকানে যাচ্ছেন কিন্তু তাদের নিরাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে। কারণ খুচরা বাজারে এখনো হ্রাসকৃত দাম কার্যকর হয়নি। কবে হবে তাও বলতে পারছেন না খুচরা বিক্রেতারা। তাহলে গত শনিবার(১৬ জানুয়ারি) থেকে নতুন দাম কার্যকরের যে ঘোষণা এল, তার মানে কী? কোন পর্যায়ে নতুন দাম কার্যকর হওয়ার কথা তা কেন স্পষ্ট করা হলো না। যদি খুচরা বাজারের কথা বলা হয়ে থাকে তাহলে কেন তা মনিটরিং করা হচ্ছে না? আর খুচরা বাজারের কথা না বলা হলে, কবে থেকে খুচরা বাজারে হ্রাসকৃত মূল্যে তেল পাওয়া যাবে তাও কেন বলা হচ্ছে না?
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী আন্তর্জাতিক বাজারে গত অক্টোবরে প্রতি টন সয়াবিন ৬২৩ ডলার ও পাম তেল ৫৩০ ডলারে লেনদেন হয়েছে। এ হিসাবে প্রতি লিটার সয়াবিন ৫০ টাকা ও পাম তেল ৪২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অথচ দেশের বাজারে বর্তমানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ৭৮ থেকে ৮০ টাকা ও পাম তেল ৬০ থেকে ৬২ টাকায় ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে। গত ৫ বছরের মধ্যে ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম ছিল সর্বোচ্চ। ওই বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন ১ হাজার ২৮০ ডলার হিসাবে বিক্রয় হয়েছে। প্রতি লিটার সয়াবিনের সর্বোচ্চ দাম ছিল প্রায় ১০০ টাকা। প্রতি টন ১ হাজার ২৪৮ ডলার হিসাবে প্রতি লিটার পাম তেল ৯৩ টাকায় লেনদেন হয়। তখন দেশের বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১১০ ও পাম তেল ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তখন আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে স্থানীয় দরে লিটারে ব্যবধান ছিল ৭ থেকে ১০ টাকা। পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে ধস নামায় দেশে দাম কিছুটা কমে এলেও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ব্যবধান অনেক বেশি। ক্রেতাদের প্রতি লিটার সয়াবিন তেল প্রায় ৩০ টাকা ও পাম তেল ২০ টাকা বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। এখন সরকার দেনদরবার করে লিটারপ্রতি সয়াবিন তেলের দাম পাঁচ টাকা কমাতে রাজি করিয়েছেন কিন্তু এখনো চলছে গড়িমসি। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আগের বেশি দামে কেনা তেল বিক্রি না করে নতুন দাম কার্যকর করা যাবে না। মিডিয়ায় প্রকাশিত সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে তারাও এই যুক্তি গ্রহণ করেছেন। তবে কথা হলো, এরকম তো অনির্দিষ্ট সময় চলতে পারে না। নির্দিষ্ট করে বলা হোক অমুক তারিখ থেকে খুচরা বাজারে নতুন দাম কার্যকর হবে। এর মধ্যে ব্যবসায়ীদের মূল্য সমন্বয় করতে হবে। সরকারের তরফ থেকে বাজার মনিটরিংয়ের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হোক।
আমদানি নির্ভর এই ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মুষ্টিমেয় কয়েকটি বিজনেস হাউস। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার সুযোগে এক বছরে তারা শত কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা করেছে, এখন কমাতে গেলেই তাদের যত টালবাহানা। ক্রেতাস্বার্থ রক্ষা সরকারের কর্তব্য হলেও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে সরকারের অসহায়ত্বই বারবার প্রকাশ পাচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য ভোজ্যতেলের বাজার সিন্ডিকেটেনের কবলমুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকে। ক্রেতাস্বার্থ রক্ষায় সরকারের আন্তরিক ও সবল ভূমিকা দেখতে চায় দেশের মানুষ।